গরুর শারিরিক বৃদ্ধি, প্রজনন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা
অামরা গরু ছাগলের খাবারের পিছনে দৈনিক শত শত টাকা খরচ করলেও না বুঝার কারণে মাত্র ২০-৩০ পয়সা খরচ না করার ফলে দীর্ঘমেয়াদী অনেক ক্ষতির সম্মূক্ষিণ হচ্ছি তা অামরা জানিই না। যেমন অামরা প্রতিদিনই গরুকে ডিসিপি বা লাইম পাউডার বা ঝিনুক গুড়া দিচ্ছি কিন্তু তা সঠিক ভাবে শোষন হচ্ছে না শুধু মাত্র ভিটামিন ডি না থাকার কারণে। ফলাফল দাড়াচ্ছে অামরা খরচ করছি কিন্তু ফলাফল শূণ্য এবং গরুর শরীরের ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না। ফলে নানাবিদ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তেমনি ভিটামিন এ এর অভাবেও গরুর গ্রুথ সহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তা দৈনিক মাত্র ২০-৩০ পয়সায় এসব ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। অনেকে তিন মাস পরপর এ সব ইনজেকসান দিয়ে থাকেন। এর সমস্যা হল ভিটামিন ই শরীরে সামান্য জমা হলেও ভিটামিন ডি শরীরে শোষন হয়না। তাই এর ঘাটতি পূরণের জন্য প্রতিদিনই খেতে দিতে হবে।
গরুর শাররীক বৃদ্ধি, প্রজনন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যে তিনটি ভিটামিন A, D এবংE গরুর জন্য অত্যাবশকীয় কিন্তু সামন্য ভিটামিন ই ছাড়া বাকি দুটি রেশনে পাওয়া যায় না। বিশেষ করে যারা দানাদার খাবার ও শুকনা খড়ের উপর নির্ভরশীল তাদের রেশনে এই তিনটি ভিটামিন পাওয়া যায় না বললেই চলে। কিন্তু এই তিনটি ভিটামিন গরুর গ্রুথ, প্রজনন ও সু স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য্য তা আমরা অনেকেই জানি না বা জানলেও মানি না। একে করে অাপনার কতটুকু ক্ষতি হচ্ছে তা অাপনি জানেন না। নিন্মে ভিটামিন তিনটির সংক্ষিপ্ত অালোচনা করা হল।
ভিটামিন এ
উৎস
ভিটামিন- এ কোন দানাদার খাদ্যে পাওয়া যায় না কারণ এটি সূর্য়্যের তাপে বা অতিরিক্ত তাপে নষ্ট হয়ে যায়। শুধুমাত্র প্রাণিজ উৎস (যেমন মাছ, মাংস ডিম, দুধ) ও সবুজ কাঁচা ঘাসে ভিটামিন এ পাওয়া যায়। কিন্তু গরুকে প্রাণিজ উৎস থেকে খাবার প্রদান করা প্রায় অসম্ভব। এবং কাঁচা ঘাসে খুব অল্প পরিমাণে ভিটামিন – এ থাকে তাই সাপ্লিমেন্ট দেওয়া জরুরী।
পরিমাণ
গরু মোটাতাজাকরনের জন্য রেশনে ২২০০ IU/Kg, গর্ভবতী গরুর জন্য ২৮০০ IU/Kg এবং দুধের গরুর জন্য ৩৬০০ IU/Kg ঘনত্ব থাকা জরুরী। তাই সঠিক পরিমাণে সরবরাহের জন্য ভাল ভাবে হিসাব করা জরুরী।
ভিটামিন এ এর অভাবে যে লক্ষণ গুলো পরিলক্ষিত হয়
খাবার গ্রহন কমে যাওয়া, লোম রুক্ষ হয়ে যাওয়া, হাড়ের জোড়া ও চোয়াল ফুলে যাওয়া, গ্রুথ কম হওয়া, অতিরিক্ত অভাবে নিয়মিত ওজন কমতে থাকা, কোন কারণ ছাড়াই প্রায় পাতণা পায়খানা হওয়া, হাড়ের গঠন ঠিকমত না হওয়া, গভর্পাত হওয়া, সিমেন কোয়ালিটি খারাপ হয়ে যাওয়া, শরীরে নানা স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হওয়া, রাতকানা রোগ হওয়া, অন্ধ বাছুর জন্ম দেওয়া, খাবার গ্রহন কমে যাওয়ার কারণে দুধ উৎপাদন কমে যাওয়া সহ অারো শারিরিক সমস্যা দেখি দিতে পারে। তাই কোন ভাবেই যেন ভিটামিন এ ঘাটতি না থাকে সে দিকে খেয়াল রাখা।
ভিটামিন – ডি
হাড়ে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস অ্যাবজর্ব এর জন্য ভিাটামিন ডি অত্যাবশকীয়। ভিটামিন ডি এর অনুপস্থিতে শরীরে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের ঘাটতি দেখা দিবে। ভিটামিন ডি দুই ধরনের হয় – ভিটামিন ডি২ যা উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যায় ও ডি৩ যা প্রাণিজ খাবার থেকে পাওয়া যায়। ভিটামিন ডি৩ ফ্যাট সলিবল তাই অতিরিক্ত মাত্রায় দেওয়া যাবে না। ভিটামিন ডি এর অন্যতম অারেক উৎস হল সুর্যালোক। প্রতিদিন গরুকে রোদে দিলে অারো বেশি ভিটামিন ডি উৎপন্ন হবে।
কতটুকু প্রয়োজন
মোটাতাজাকরনের জন্য ২৭৫ IU/Kg, এবং দুধের গরুর জন্য ৩৫০-৪০০ IU/Kg প্রয়াজন।
ভিটামিন – ডি এর অভাবে যে লক্ষণ গুলো পরিলক্ষিত হয়
ভিটামান ডি এর অভাবে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষন না হওয়া কারণে গ্রুথ কমে যাওয়া দুধের গরুর মিল্ক ফিভার হওয়া এমনকি মৃত্যু পর্ডন্ত হতে পারে, বাছুরের রিকেট হওয়া, গরু ঠিক মত অনেকক্ষন দাড়াতে পারবে না, শরীর কাপঁতে থাকবে, দুধের ঘনত্ব কমে যাবে, হাড় দুর্বল হয়ে যাবে। সহজে বুঝার ব্যবস্থা হল গ্রুথ কমে যাবে গরু সবসময় হাপাতে থাকবে, শরীর অতিরিক্ত দুর্বল থাকবে ও হজমে সমস্যা দেখা দিবে।
ভিটামিন ই
ভিটামিন ই হল ফ্যাট সলিবল একপ্রকার এন্টিওক্সিডেন্ট যা ফ্যাটে অক্সিজেন শোষনের পর কোন ক্ষতির কিছু থাকলে ভিটামিন ই তা নিউট্রালাইজ করে। ভিটামিন ডি সাধারনত পালং শাক, ধনিয়া পাতা, মুলা শাক, সরিষার শাক, বাদাম জাতীয় খাবার, খৈলে পাওয়া যায় তবে তা খুব বেশি পরিমানে নয়। তাই চাহিদা পূরণের জন্য সাপ্লিমেন্ট প্রয়োজন।
ভিটামিন ই রেশনে কতটুকু প্রয়োজন তা অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন সালফার সমৃদ্ধ অ্যামিনো এসিড কতটুকু অাছে, রেশনে কতটুকু সেলিনিয়াম অাছে, রেশনে কতটুকু পলিস্যাটুরেটেড ফ্যাট (যা অামরা কখনই হিসাব করিনা) অাছে। সাধারনত শরীরে ভিটামিন ডি এর মতই ভিটামিন ই খুব বেশি একটা জমা হয় না তাই নিয়মিত প্রদান করতে হবে। রেশনে ভিটামিন ই সর্বনিন্ম ১৫-২০ IU/Kg থাকতে হবে। তবে ফিনিশিং ও ডেইরীর জন্য তা ৫০-৬০ IU/Kg পর্যন্ত দিতে হতে পারে।
ভিটামিন ADE সাপ্লিমেন্টের প্রয়োগ
যেহেতু এইতিনটি ভিটামিন রেশনে পাওয়া যায় না তাই সাপ্লিমেন্ট ন্ দিয়ে উপায় নেই। অামার জানা মতে স্কয়ার ফার্মা “ES-ADE Solution” এবং এসিআই ‘Acivit – ADE Oral Solution’ নামে বাজারজাত করছে। যার প্রতি মিলিতে ভিটামিন A-1 Lac IU, D- 20,000 IU এবং E -20mg অাছে।যার ১০০ মিলি দাম ১৫০-১৬০ টাকা। তবে বড় প্যাক ক্রয় করলে খরচ কম পড়বে। তবে অন্যকোন প্রতিষ্ঠানের এই প্রোডাক্ট থাকলে এবং সমপরিমান উপাদান ও দাম ঠিক থাকলে তাও ব্যবহার করতে পারবেন।
ব্যবহারের নিয়ম
সঠিক ও নিখুঁত ভাবে ব্যবহার করতে চাই অনেক বিষয় বিবেচনায় অানতে হবে এবং জানতে হবে। তাই সকলেই যেন সহজে ব্যবহার করতে পারে সেইদিকে লক্ষ রেখে এটি অামি ব্যক্তিগতভাবে ফর্মুলাটি তৈরি করেছি। কারো কাছে ভাল পরামর্শ থাকলে দিবেন এতে সকলেরই উপকার হবে। ঔষধ কোম্পানী প্রতি মিলিতে যে পরিমাণ উপাদান অাছে উল্লেখ করেছে তা বিদ্ধমান থাকলে নিন্মরূপে খাওয়ালে ভিটামিন এ এবং ডি এর চাহিদা পূর্ণ হবে। তবে এখানে যে পরিমাণ ভিটামিন ই অাছে তা দিয়ে ই এর চাহিদা সম্পূর্ণ হবে না তাই প্রাকৃতিক ভাবে রেশন থেকে পূর্ণ করতে হবে।
১ লিটর জলতে ১.২৫ মিলি ভিটামিন এডিই ভাল ভাবে মিশ্রিত করবেন। এর পর ২০ কেজির বেশি দুধ দেয় এমন গরুকে ৫০০ মিলি, ১৫ কেজি দুধের গরুকে ৪০০ মিলি, ১০ দুধের গরুকে ৩০০ মিলি, ৫ কেজি দুধের গরুকে ২০০ মিলি দিবেন। মোটাতাজাকরনের ক্ষেত্রে ১০০ কেজি বা কম ওজনের গরুকে ৫০-৬০ মিলি, ২০০ কেজি গরুকে ১০০ মিলি, ৩০০ বা তার অধিক ওজনেন গরুকে ১৫০ মিলি দিবেন। তবে যারা দীর্ঘদিন যাবৎ এই ভিটামিন তিনটি দিচ্ছেন না তারা প্রথম সাত দিন ১ লিটার জলতে ৫ মিলি ভিটামিন মিশিয়ে খাওয়াবেন। একদিনের মিশ্রন পরের দিনের জন্য রাখবেন না। ভিটামিন মিশ্রিত জল দানাদার খাবার বা সাদা জলর সাথে বা অন্য যেকোন ভাবে খাওয়ালেই হবে তবে যেন নষ্ট না হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ১ মিলি পরিমাণ মাপার জন্য বাচ্চাদের ঔষধ খাওয়ানোর জন্য ড্রপার ব্যবহার করতে পারেন অথবা হাটখোলা বা মিডফোর্ড থেকে মাপার সরঞ্জাম ক্রয় করে নিতে পারেন এবং ৫০/১০০ মিলি মাপার জন্যও ঔষধের ছোট বোতল ব্যবহার করতে পারেন। এখানে অামি একটি কথা অাবারো বলছি, ভিটামিন নিখুত পরিমাণে দিতে চাইলে যে হিসাব অাসবে তা অনেকে বুঝতে অসুবিধা হবে তাই সহজ ভাবে বুঝানোর জন্য এই ভাবে ব্যবহার করতে বলা হলো।
গবাদি পশুর রুমেনর ph নিয়ন্ত্রনের কৌশল
গরুর রুমেনের স্বাভাবিক ph ৬.৫- ৭.০। কিন্তু খাবারের ভারসাম্যহীনতার জন্য কখনও ph স্বাভাবিক এর চেয়ে কম বা বেশি হয়ে যায়। এতে করে খাবারে অরুচি, বদহজম দেখা দেয়, খাবার গ্রহন কমে যায়, দুধের উৎপাদন ও দুধের ফ্যাট কমে যাওয়াসহ নানা ধরণের মেটাবলিক এবং শরীরবৃত্তীয় সমস্যা দেখা দেয়। এইসব সমস্যা থেকে পরিত্রান পেতে নিন্ম লিখিত নিয়ম গুলো মেনে চললে সহজেই রুমেন ph নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব।
- রুমেন ph নিয়ন্ত্রনের জন্য মোট রেশনের ৬০% এর বেশি দানাদার খাবার দেওয়া ঠিক হবে না।
- দানাদার খাবারে ৫০-৬০% এর বেশি স্টার্চ ও সুগার হওয়া যাবে না।
- দানাদার খাবার তিন বারে নিদিষ্ট সময়ে প্রদান করুন। এতে পাকস্থলীতে বেশি সময় ফারমেনটেশন/ গাঁজন হতে পারবে না।
- গরুকে জাবর কাটার সময় দিতে হবে। কারণ জাবর কাটার সময় যে লালারস নির্গত হয় তা ক্ষারীয় যা ph এর ভারসাম্য রক্ষা করে।
- অামরা অনেক সময় মিনারেল ও ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট দেই তা দানাদার খাবারে উপস্থিত মিনারেলের সাথে যোগ করে প্রয়োজন ও টলারেন্স এর মধ্যে রাখতে হবে।
- গরুকে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ জল দিতে হবে। জলর সল্পতার কারণে রুমেন ও রক্তের ph হ্রাস পেতে পারে। খাাবার পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে ব্যকটেরিয়া জমতে না পারে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল দিলে শরীরে মিনারেল ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তাই জলর সাথে লবন, চিটাগুড়, ভূষি মিশাবেন না এতে জলর স্বাদ পেয়ে বেশি খেয়ে ফেলতে পারে।
- পরিমাণের বেশি ইউরিয়া সাপ্লিমেন্ট দিবেন না। বর্ষাকালে বা জলাবদ্ধ জায়গা থেকে ঘাস দেওয়ার সময় ইউরিয়া সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করবেন না। এতে রুমেন ph মারাত্নক ভাবে কমতে পারে।
- রেশনে মিনারেলের পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি এবং ম্যাক্সিমাম টলারেন্স এর বেশি খাওয়ানো হচ্ছে কিনা সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন ডাল জাতীয় খাবারে অায়রন, চিটাগুড়ে সালফার, ধানের কুড়ায় ম্যাগনেসিয়াম অনেক বেশি থাকে। তাই পরিমান মত না খাওয়ালে রুমেন ph কমে যেতে পারে।
সূত্র: বিকাশপিডিয়া টীম
No comments:
Post a Comment