ম্যাস্টাইটিস" কাহিনী। রিপন সরকার। Ripon Sarkar


"ম্যাস্টাইটিস" কাহিনীঃ
















 

ম্যাস্টাইটিস বা ওলান পাকা রোগটি একজন খামারীর জন্য খুবই বড় একটি দুঃসংবাদ। একটি ভাল দুধের গাভী পাওয়া বা তৈরি করা খুবই কঠিন। তো, এই গাভীটি যদি ম্যাস্টাইটিসে আক্রান্ত হয় তবে খামারীর মাথায় যেন বাজ পড়ে। ম্যাস্টাইটিস ডেইরী সায়েন্সের অনেক বড় একটি চ্যাপ্টার। চলুন তাত্ত্বিক আলোচনায় না গিয়ে ব্যাপারটি সহজে বোঝার চেষ্টা করি।

ম্যাস্টাইটিস অনেক প্রকার। আমাদের বোঝা দরকার দুই প্রকারঃ-

১. লক্ষণহীন ম্যাস্টাইটিসঃ (Subclinical Mastitis)

দুধ দেখতে স্বাভাবিক। জীবাণু ওলানে ঢুকে বসে আছে। এখনও কোন লক্ষণ প্রকাশ পায়নি- শুধু দুধে দেহকোষের (Somatic cell) পরিমাণ বেড়ে গেছে।

২. লক্ষণযুক্ত ম্যাস্টাইটিসঃ (Clinical Mastitis)

প্রধান লক্ষণ দুধ অস্বাভাবিক (রঙ পরিবর্তন, বাট দিয়ে পানি আসা, ছাকড়া ছাকড়া দুধ, পুঁজের মত ইত্যাদি)। এছাড়া তীব্রতা অনুযায়ী অন্যান্য লক্ষণগুলোঃ- যেমন, ওলান ফুলে যাওয়া, চাকা চাকা ভাব, গরম ওলান, জ্বর, তীব্র ব্যথা, এমনকি ওলানে পচন ধরা (gangrene) পর্যন্ত হতে পারে।

কারণ ও প্রতিরোধঃ-

১. SCS স্কোরঃ-

আমরা ম্যাস্টাইটিস হলে প্রথমে খামারীর অজ্ঞতাকে ও দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে দোষ দেই। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছেন কি-- দেশীয় গরুতে তো এত ম্যাস্টাইটিস হয়না। আমাদের দেশের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা ল্যাবরেটরির কালচার রুমের মত। এইরকম তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় ব্যাক্টেরিয়ার বংশবিস্তার খুবই বেশি। যার দরুন ম্যাস্টাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। তাই আমাদের এমন বুলের সিমেন দরকার যার EPD তে SCS কম (Somatic Cell Score)। সাধারণত এই স্কোর ২.৫---৩.৫ পর্যন্ত নরমাল ধরা হয় (USA, Canada, New Zealand প্রভৃতি দেশে)। স্কোর যত কম দুধের মধ্যে দেহকোষ (Somatic Cell) তত কম। আমাদের দেশটা যেহেতু উষ্ণ ও আর্দ্র তাই আমাদের দরকার এমন বুলের সিমেন যার SCS স্কোর ২.৫ বা তার কাছাকাছি। ৩ এর উপরে হলে বিপদ বাড়তে পারে। আমাদের দেশে যে পরিমানে ম্যাস্টাইটিস হয় তাতে মনে হয়-- যেসব সিমেন এদেশে সহজলভ্য তাদের বাবা-নানা-দাদার EPD তে SCS স্কোর বেশি ছিল। যাইহোক, এসব EPD কেউ প্রকাশ করছে না- তাই সঠিক করে বলার উপায় নেই। অতএব SCS স্কোর বেশী হওয়ার কারনে যত ম্যাস্টাইটিস হচ্ছে তাতে খামারীর দোষ কম।

২. টিট ডিপিং:-

ম্যাস্টাইটিসের জীবানু গাভীর বাটের বাইরে লেগে থাকতে পারে। তাই দুধ দোয়ানোর আগে বাট ভালোভাবে পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।

যিনি দুধ দোয়াবেন তিনি প্রথমে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে হাতে রাবিং এলকোহল (যেমন হেক্সিসল) ঘষে নিবেন।

তারপর পভিডন আয়োডিন (যেমন ভায়োডিন ১০%) গাভীর বাটে স্প্রে করতে হবে।

(টিট ডিপিং কাপ বা বাটিতে করে বাট চুবিয়ে দিলে- একই তরল সব বাটে লাগছে- এর চেয়ে স্প্রে বেশি নিরাপদ।)

এবার একটি ধোয়া কাপড় বা রুমালের চারকোণা দিয়ে চারটি বাট মুছে দিন।

একটু খানি দুধ ফেলে এরপর পাত্রে দুধ দোয়ান। দোয়ানো শেষ হলে আবার বাটে পভিডন আয়োডিন স্প্রে করুন।

অন্তত এক-দুই ঘন্টা গাভীকে বসতে দিবেন না। কারন দুধ দোয়ানোর পর ঘন্টাখানিক বাটের মুখ খোলা থাকে- এসময় বসে পড়লে ফ্লোরের ব্যাক্টেরিয়া ঢুকে পড়তে পারে।

ভাই, কঠিন লাগছে???

--- একবার এই সিস্টেম খামারে চালু করে দেখুন- ম্যাস্টাইটিস হবার সম্ভাবনা ৯০% কমে যাবে। খুব বেশি জিনিস তো লাগছে না।

যা যা লাগছেঃ-

১. প্রত্যেক গাভীর জন্য আলাদা পরিষ্কার রুমাল- প্রতিবার ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে নিবেন। 

২. হাতে ঘষার রাবিং এলকোহল। (যেমন হেক্সিসল)।

৩. দোয়ানোর আগে ও পরে বাটে দেয়ার পভিডন আয়োডিন (যেমন ভায়োডিন ১০%)। চাইলে গ্লিসারিন বা পানি মিশিয়ে পাতলা করে নিতে পারেন (১০% থেকে কমিয়ে ১% থেকে ৫% পর্যন্ত পাতলা করা যাবে)

চিকিৎসাঃ-

১. লক্ষণহীন ম্যাস্টাইটিসের চিকিৎসা হল ম্যাস্টিকেয়ার জাতীয় ঔষধ যার মধ্যে ভিটামিন, প্রোবায়োটিক ও ইমিউনিটি বুস্টার থাকে। কিন্তু সমস্যা হল যার লক্ষণ নাই তারে চিনবেন কিভাবে? চিনার সহজ রাস্তা একটাই- তা হল CMT পরীক্ষা।

CMT পরীক্ষাঃ

California Mastitis Test কিট বা CMT কিট হল হ্যান্ডেলওয়ালা জোরা লাগানো চারটি বাটি ও বেগুনী রংয়ের CMT তরলের বোতল।

(ACI বিক্রি করে- বাটি ৪০ টাকা, ১০০ মিলি তরল ৩৫০-৪০০ টাকা)

টেস্ট করা খুবই সহজ। চার বাটের দুধ চার বাটিতে নিন। দুই মিলি দুধে দুই মিলি করে বেগুনী তরল ঢালুন। নাড়াচাড়া করুন---ম্যাস্টাইটিস থাকলে তরল ও দুধ মিলে থকথকে আকৃতি ধারন করবে (অ্যালোভেরার জেলীর মত)। ম্যাস্টাইটিস না থাকলে তরল তরলই থাকবে। 

ইউটিউবে Nurul Amin স্যারের ভিডিও আছে- দেখে নিন।

২. লক্ষণযুক্ত ম্যাস্টাইটিসের চিকিৎসাঃ-

এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন ও ইন্ট্রাম্যামারী ইনফিউশন (বাটে ঢুকানোর টিউব)- সাথে ম্যাস্টিকেয়ার জাতীয় ঔষধ ও ব্যাথানাশক। কিন্তু এই চিকিৎসাটি অবশ্যই অবশ্যই রেজিস্টার্ড ভেট চিকিৎসক দ্বারা করাতে হবে। পচন ধরলে ড্রেসিংও তিনিই করবেন। আমাদের কাজ শুধু ওলানে ঠান্ডা পানি মারা, বরফ শেক দেয়া ও ঘন ঘন বাট টেনে দুধ বের করা। বাট বন্ধ হয়ে গেলে 'টিট সাইফন' দিয়ে দুধ বের করার কাজটিও অভিজ্ঞ ভেটই করবেন।

করণীয়ঃ-

১. ম্যাস্টাইটিসের টীকা (SKF) দিতে পারেন। তবে টীকা পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারে না- শুধু লক্ষণগুলো তীব্র হতে দেয় না।

২. লক্ষণহীন ম্যাস্টাইটিস হতেই লক্ষণযুক্ত ম্যাস্টাইটিস তৈরি হয়। তাই লক্ষণহীন ম্যাস্টাইটিস আগে ভাগে ধরে ফেলার কোন বিকল্প নাই। এজন্য প্রতিটি খামারে আবশ্যিকভাবে CMT কিট দিয়ে ১৫ দিন পরপর ম্যাস্টাইটিস পরীক্ষা কার্যক্রম (Mastitis Screening Program) চালাতে হবে। ১৫ দিনে না পারলে অন্তত প্রতিমাসে একবার করুন। প্রতি গরুতে মাত্র ৩২ টাকার CMT তরল লাগে। যে গরুগুলোতে লক্ষণহীন ম্যাস্টাইটিস পেয়ে যাবেন সেগুলোকে আলাদা রাখুন- ম্যাস্টিকেয়ার জাতীয় ঔষধ খাওয়ান। এদের দুধ সবার শেষে দোয়াবেন। ম্যাস্টিকেয়ার জাতীয় ঔষধ ফুলডোজ খাওয়ানো শেষ হলে আবার CMT পরীক্ষা করে দেখুন- ভাল হল কিনা? কোন গাভীতে বারবার CMT পরীক্ষা পজিটিভ হলে সেটিকে খামার থেকে বাদ দেয়ার (কালিং) চিন্তা করুন। এটি ক্রনিক ম্যাস্টাইটিসের লক্ষণ- এটি চিকিৎসায় ভাল হবে না, বরং অন্য ভাল গাভীতে ম্যাস্টাইটিস ছড়াবে।

৩. খামারের মেঝে পরিষ্কার রাখুন। কয়েকদিন পরপর মেঝে ব্লিচিং পাউডার বা কাপড় কাচার সোডা দিয়ে পরিষ্কার করুন। গাভীকে দিনের বেলা বেড়া দেয়া বালিযুক্ত নরম মাটিতে ছেড়ে দিয়ে পালতে পারলে ম্যাস্টাইটিসের প্রকোপ কমবে।

৪. মিল্কিং মেশিন ব্যবহার করলে প্রত্যেকবার দুধ দোয়ানোর পর নির্দেশিত জীবাণুনাশক তরল ও গরমপানি দিয়ে তা উত্তমরুপে ধুতে হবে। কোন গাভীতে লক্ষণহীন ম্যাস্টাইটিস পেলে সেটিতে মিল্কিং মেশিন ব্যবহার করবেন না।

৫. ম্যাস্টাইটিস বনাম ওলানে পানি আসাঃ-

বকনার প্রথম বাচ্চা দেয়ার সময় নতুন ওলান তৈরি হয়- এসময় ওলানে পানি আসে। আবার অনেক সময় গাভীর ড্রাই পিরিয়ডে দানাখাদ্য বেশি খাওয়ালে ও ভিটামিন মিনারেলের ঘাটতি হলে ওলানে পানি আসতে পারে- কিন্তু এটি ম্যাস্টাইটিস নয়। অভীজ্ঞ ভেটেরিনারী ডাক্তারগণ কিন্তু এটি চোখে দেখেই বুঝে ফেলেন। কিন্তু আপনার আমার জন্য CMT পরীক্ষার বিকল্প নাই। ম্যাস্টাইটিসে ঠান্ডা পানি মারতে হয়, অপরদিকে ওলানে পানি হলে গরম সেক লাগে। ওলানে পানি তেমন কোন মারাত্মক সমস্যা নয়। ডাক্তাররা অনেক সময় অ্যান্টিহিস্টামিন, ডাইয়ুরেটিকস জাতীয় ঔষধ দিয়ে থাকেন।

৬. ম্যাস্টাইটিসের নানা রকম টোটকা চিকিৎসা (হার্বাল, হোমিওপ্যাথি, কর্পূর-শরীষার তেল, অ্যালোভেরা-লেবু-হলুদ ইত্যাদি) আছে। সেগুলোতে অনেকসময় কাজ হয়- অনেকসময় কাজ হয় না। তাই ভাই, CMT পরীক্ষা দ্বারা লক্ষণহীন ম্যাস্টাইটিস আগে ভাগেই ধরে ফেলে তার ব্যবস্থা নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। 

এবার ভাই নিজেকে প্রশ্ন করুন-- ম্যাস্টাইটিস ঠেকানোর চারটি অত্যাবশ্যকীয় জিনিস আপনার খামারে আছে কি??????

১. প্রত্যেক গাভীর আলাদা রুমাল

২. রাবিং এলকোহল (হেক্সিসল)

৩. পভিডন আয়োডিন (ভায়োডিন ১০%)

৪. CMT কিট (বাটি ও তরল)

অতএব, না থাকলে আজকেই কিনে শুরু করুন।

"প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।


No comments:

Post a Comment