রোগী ও তার আত্মীয়স্বজন এমনকি ডাক্তাররাও যেন একটা ল্যাবরেটরিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা টেস্ট করিয়ে স্বস্তি পান না। যখন একই টেস্ট বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে করা হয়; তখনই ঘটে বিপত্তি। ভিন্ন ভিন্ন ল্যাবরেটরির ফলাফল ভিন্ন রকম হয়। তখন দোষ এসে পড়ে প্যাথলজিস্ট ও ল্যাবরেটরির ওপর। এক্ষেত্রে আপনার করণীয় কী সেটা নিয়ে আলোচনা করি।
বর্তমানে রোগ নির্ণয় সঠিক প্যাথলজি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার ফলাফলের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। আগে রোগীর নাড়ি দেখে, হাঁটাচলা দেখে রোগ নির্ণয় সম্ভব হলেও এখন এটা প্রায় অসম্ভব। বর্তমানে যে কোনো রোগ নির্ণয়ের পূর্বশর্ত হল রোগীর সঠিক রোগের ইতিহাস, ফিজিক্যাল পরীক্ষা এবং সবশেষে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা। এ তিনটির সমন্বয় ছাড়া বর্তমানে কোনো রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং পরবর্তী ফলোআপ সম্ভব নয়।
কোনো রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে চিকিৎসক রোগীর ইতিহাস, ফিজিক্যাল পরীক্ষা করে তারপর একটা ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস করেন। এ ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিসের ওপর ভিত্তি করে রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা করানোর উপদেশ দেন। এরপর রোগী তার পছন্দমতো বা চিকিৎসকের উপদেশ নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করানোর জন্য যান। কোনো ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য গেলে আপনি নিচের জিনিসগুলো অবশ্যই লক্ষ করবেন এবং আশ্বস্ত হলে পরীক্ষাগুলো করাবেন-
* ল্যাবরেটরির জন্য প্রশস্ত জায়গা, বাথরুমের সুবিধা, বসার জায়গা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি আছে কি?
* ল্যাবরেটরিতে বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট আছে কি?
* দক্ষ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ডিগ্রিধারী ল্যাব টেকনোলিজস্ট , প্যারামেডিক্স আছে কি?
* ল্যাবরেটরিতে পর্যাপ্ত মেশিনপত্র, তৈজসপত্র, ইলেকট্রিক ফ্যাসিলিটি ইত্যাদি আছে কি?
* রিসেপশন কাউন্টার সঠিক লোক দ্বারা পরিচালিত কিনা, সেখানে সরকারি মূল্যের চার্ট আছে কিনা, কী কী পরীক্ষা ওই ল্যাবরেটরিতে করা হয়- তার তালিকা আছে কি?
এগুলোর খোঁজখবর নেয়ার পর আপনি যদি আশ্বস্ত হন তবেই রিসেপশনে ডাক্তারের উপদেশ জমা দিয়ে রসিদ নেবেন এবং লক্ষ করবেন ডাক্তার যেসব পরীক্ষার উপদেশ দিয়েছেন তা সঠিকভবে তোলা হয়েছে কিনা এবং মূল্য চার্ট অনুযায়ী চার্জ রাখা হয়েছে কিনা। এরপর রোগী কালেকশন বুথে যাবেন। যদি রক্ত পরীক্ষা থাকে তাহলে স্টেরালাইজড বা জীবাণুমুক্ত ডিসপোজেবল রক্ত সিরিঞ্জ অথবা আধুনিক ভাকুটেনার ব্যবহার হয়েছে কিনা সেটা নিশ্চিত হবেন। সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করার পর রক্ত সংগ্রহ করতে হবে এবং লক্ষ করবেন রোগীর সংগৃহীত রক্ত বা পরীক্ষণীয় বস্তুর গায়ে নম্বর সঠিকভাবে লাগল কিনা এবং খাতায় তোলা হল কি না।
প্রস্রাবের রুটিন টেস্টের জন্য সকালে ঘুম থেকে উঠে যে প্রস্রাব প্রথম হবে সেটা সংগ্রহ করতে হবে। প্রস্রাবের কালচার ও সেনসিটিভিটি পরীক্ষার জন্য বিশেষ করে নির্জীবিত টেস্ট টিউবে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে প্রথম প্রস্রাবের মাঝখান থেকে Mid Stream নিলে পরীক্ষা সঠিক হবে। মহিলাদের ক্ষেত্রে যোনিরস, মাসিকের রক্ত ইত্যাদি যেন প্রস্রাবের সঙ্গে মিশ্রিত না হয় সে জন্য যোনিপথ ভালোমতো পরিষ্কার করে তবেই প্রস্রাব দিতে হবে। কফের রুটিন বা এএফবি (অঋই) টেস্টের জন্য পরপর তিন দিন সকালে খুব ঘন কফ দিতে হবে। থুথু বা লালা দিলে হবে না। ম্যালিগন্যান্ট বা ক্যান্সার সেলের জন্য পরপর তিন দিন ঘন কফ পরিষ্কার পাত্রে সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হবে। পায়খানা পরীক্ষার জন্য বড় মুুখ ফুড প্লাস্টিক বা কাচের পাত্রে সংগ্রহ করে পাঠাতে হবে। গলার সোয়াব পরীক্ষার জন্য সকালে মুখ না ধুয়ে ল্যাবরেটরিতে যেতে হবে। জরুরি ক্ষেত্রে যে কোনো সময় গলা থেকে সোয়াব নেয়া যেতে পারে। অভুক্ত অবস্থায় শর্করা বা লিপিড প্রফাইলের জন্য রক্ত দিতে হবে। ফাঙ্গাস রুটিন টেস্টের জন্য কোনো ওষুধ না খেয়ে এবং ৭ দিন মলম না লাগিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে হবে। সিমেন বা ধাতু এনালাইসিসের জন্য পরপর তিন দিন সঙ্গম থেকে বিরত থেকে তারপর তা সংগ্রহ করতে হবে।
স্যাম্পল দেয়ার পর জেনে নেবেন কখন রিপোর্ট নেবেন এবং সেই অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে রিপোর্ট সংগ্রহ করবেন। রিপোর্ট নেয়ার সময় সম্পর্কেও ধারণা থাকা উচিত। যেমন- সাধারণত কালচার ও সেনসিটিভিটির জন্য ৪৮ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন। রক্তের কালচারের জন্য ৩, ৫, ৭, ১০ দিন, এই ৪ দিন দেখতে হবে এবং ৪ দিনের রিপোর্ট দিতে হবে। ফাঙ্গাস কালচারের জন্য ৩ সপ্তাহ এবং অঋই বা যক্ষ্মার জীবাণু কালচারের জন্য ৬ সপ্তাহ সময় লাগবে। হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষার জন্য ৩ থেকে ৫ দিন সময় প্রয়োজন। অন্যান্য রুটিন ও বায়োকেমিক্যাল টেস্ট ১ দিনের মধ্যেই করা সম্ভব।
রিপোর্টে তারতম্য, কারণ কী?
সঠিক রিপোর্টের জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্টের তত্ত্বাবধান, দক্ষ প্যারামেডিক্স, পাস করা দক্ষ ল্যাবরেটরি টেকনোলজিস্ট, ভালো ও আধুনিক যন্ত্রপাতি, রিএজেন্ট, কেমিক্যাল। এগুলোর কোনো এক জায়গায় ত্র“টি হলেই রিপোর্টের ফলাফলে তারতম্য হবে।
যে কোনো পরীক্ষার স্বাভাবিক মান, এর স্বাভাবিক তারতম্য সম্পর্কে রোগী, ডাক্তার সবারই একটা সম্যক ধারণা থাকতে হয়। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ধরুন রক্তের টিসি/ডিসি করার জন্য রোগীকে উপদেশ দেয়া হয়েছে। এই টিসির স্বাভাবিক রেঞ্জ প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে ৪,০০০-১১,০০০। এই টিসি তিন ল্যাবরেটরিতে করা হলো। এক ল্যাবরেটরিতে টিসি হল ৮,০০০; দ্বিতীয়টিতে ১০,০০০ এবং তৃতীয়টিতে ৭,৫০০। এই তিনটি ফলাফলই কিন্তু সঠিক। এই তারতম্যের কারণ হল বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্টের টিসি করার পদ্ধতি ও চোখে দেখার তারতম্য। বর্তমানে অটোএনালাইজারের সাহায্যে প্রায় নির্ভুল রক্তের টিসি, ডিসি, ইএসআর টেস্ট করা যায়, যেখানে ভুলের আশঙ্কা কম।
কোনো সময় রোগী টিসি পরীক্ষার জন্য রক্ত দিলে এটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সকালে স্বাভাবিকভাবে টিসি কাউন্ট কম আসে; দুপুরে বেশি হয়। খাওয়ার পর, ব্যায়ামের পর, কাজকর্মের পর, সিগারেট খাওয়ার পর এবং এড্রেনালিন ইনজেকশন নেয়ার পর টিসি কাউন্ট বেশি হবে।
কোনো কোনো সময় স্যাম্পল দুই/তিন ভাগ করে প্যাথলজিস্টের কাছে পাঠানো হয়। এটা বিভিন্ন সার্জিকেল স্পেসিমেনের হিস্টোপ্যাথলজি পরীক্ষার সময় বেশি করা হয়। ধরুন একটা লিম্ফনোড বায়োপসি করা হল। নিয়ম হল পুরো লিম্ফনোডটাই ফরমালিনে ফিক্স করে প্যাথলজিস্টের কাছে পাঠাতে হবে। কারণ প্রত্যেকটি স্যাম্পলের গ্রস কাটসেকশান এবং তারপর প্রয়োজনমতো সিরিয়াল সেকশান মাইক্রোটোম দিয়ে কেটে তারপর রোগীর ক্লিনিক্যাল ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে ডায়াগনোসিস করা হয়। সমস্যা হল কিছু ক্ষেত্রে পাঠানো স্যাম্পলের সঙ্গে ক্লিনিক্যাল ইতিহাস লেখা থাকে না এবং ওই লিম্ফনোড পুরোটা না পাঠিয়ে তিন ভাগ করে তিন ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়। কেউ ক্যান্সার বা যক্ষ্মা পান কেউ পান না।
একই প্রস্রাবের স্যাম্পল কালচারের জন্য দুই জায়গায় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট এসেছে দুই রকম। সুষ্ঠুভাবে প্রস্রাব কালেকশন এবং স্টেরিলাইজড টিউব নিয়ে ল্যাবরেটরিতে আসা জরুরি। কালেকশনের পর প্রস্রাব যদি টেস্টটিউবে নেওয়া হয়, তাহলে বাতাসে অবস্থিত জীবাণু প্রস্রাবের মধ্যে ঢুকে যাবে এবং সঠিক ফলাফল আসবে না।
দক্ষ, অভিজ্ঞ মাইক্রোবায়োলজিস্ট ছাড়া (যা বেশির ভাগ ল্যাবরেটরিতে অনুপস্থিত) ফলাফল অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ হবে না। বায়োকেমিক্যাল, সিরোলজিক্যাল টেস্টের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সিরোলজিক্যাল টেস্টের জন্য ভালো রি-এজেন্ট সংগ্রহ, সুষ্ঠু সংরক্ষণ, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও মেশিন ব্যবহার করলে ফলাফলে তারতম্য ঘটার কোনো আশঙ্কা নেই।
No comments:
Post a Comment